জি এম জাকির হোসেন :
সবুজবাংলা২৪ডটকম, দাকোপ (খুলনা) : খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামের তালেব গাজী (৭০) বসবাস করেন ঝুলন্তপাড়ার একটি কুঁড়েঘরে। ১৩ হাত লম্বা ও ৫ হাত চওড়া ওই ঘরে তার সঙ্গে থাকেন স্ত্রী আছিয়া বেগম। নদীর চরের ওপর বাঁশের খুঁটি উলম্বভাবে পুঁতে তৈরি করা হয়েছে ঝুলন্ত মাচা। তার ওপর সুন্দরবনের গোলপাতার বেড়া ও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে পাওয়া টিনের চাল রয়েছে তার ঘরে। মাঝেমধ্যে নদীতে নেট জাল টেনে সামান্য কিছু রেণু পোনা আহরণ ও কাঁকড়া ধরে সংসার চলে তালেব গাজীর। একমাত্র সন্তান আসলাম গাজী কাজের সন্ধানে বহু আগে চলে গেছেন খুলনা শহরে। সংসার চালাতে তাই ৭০ বছর বয়সী তালেবকেই এখনো সংগ্রাম করতে হয়। আজ থেকে ৩৫ বছর আগেও তালেব গাজীর এই দুর্দশা ছিল না। ওই গ্রামেই তার পৈতৃক সম্পত্তি ছিল ১১০ বিঘা। দৈনন্দিন জীবন চলত রাজার হালে। তালেব গাজী বলেন, ‘আমি জন্ম নিয়েছিলাম সোনার চামচ মুখে নিয়ে। আর মরতে হবে ভিক্ষুক বেশে। ছোটবেলায় চলতাম ঘোড়ার পিঠে। জমিতে প্রচুর ধান হতো, তা দিয়ে সারা বছর চলে যেত। অসংখ্য নৌকা ছিল, সুন্দরবন থেকে সম্পদ আহরণ করতে সেগুলো ব্যবহার করা হতো। ১৯৮৮ সালের ঝড়ে আমাদের জীবটাকে একেবারেই তছনছ করে দিয়েছে।’ ‘ওই ঝড়ের পর আমাদের ঘরের চিহ্ন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই যে নদীভাঙন শুরু হলো, আর কখনো থামেনি। সাত-আট বছরের মধ্যে ১১০ বিঘা জমি চলে গেছে শিবসা নদীর পেটে। এখন আমরা নদীর চরের পরের জমি ইজারা নিয়ে ঘর বেঁধে থাকছি। বছর বছর নদী ভাঙে, আমাদের ঘরও সরাতে হয়’, বলছিলেন তালেব গাজী। সুন্দরবনের কূলঘেঁষা কালাবগি গ্রামটি শিবসা ও সুতারখালী নদীর মোহনায় অবস্থিত। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বারবার ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের কারণে মানুষের যে দুর্দশা হচ্ছে, তার বাস্তব উদাহরণ ওই গ্রাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর ঝড়ের মূল অংশের আঘাত হানে খুলনা জেলায়। গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার, জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল সর্বোচ্চ সাড়ে ১৪ ফুট। ওই সময় থেকে কালাবগিতে শুরু হওয়া নদীভাঙন এখনো থামেনি।
তালেব গাজীর প্রতিবেশী ৬৫ বছর বয়সী আকবর গাজীও দেখেছেন বিধ্বংসী ওই ঘূর্ণিঝড়। তিনি বলেন, ‘ঝড়ের সময়ে বাড়িতেই ছিলাম। সেদিন আমার আপন এক ভাই মারা গেছে। আমাদের পাশের ঘরের কেউই জীবিত ছিল না। সেই সময়ের স্বজন হারানো শোক আমরা কেটে উঠতে পেরেছি। তবে সম্পদ হারানো চিহ্ন এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।’ আকবর গাজী আরও বলেন, ‘১৯৯৮ সালে ঝড়ের পর আমরা আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চাইলাম। তবে যে হারে নদীভাঙন শুরু হলো, তাতে আমরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারলাম না। এর পরও ছোট-বড় অনেক দুর্যোগ আমাদের মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। তবে সম্প্রতি আমরা সব থেকে বেশি ঝড়ের কবলে পড়েছি। এখন প্রায় প্রতিবছরই ঝড় হচ্ছে।